বাংলাদেশে পঞ্চাশটির উপর বিভিন্ন আদিবাসী বাস করছে। ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় গারো পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে রয়েছে গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু, হদি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এর মধ্যে গারোরা সংখ্যায় অধিক। দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হাজং। হাজংরা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, শেরপুরের নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দ্দি, সুনামগঞ্জের বংশীকুণ্ডা, মধ্যনগর থানায় বসবাস করে। এ ছাড়াও ভারতের মেঘালয়, আসাম, অরুণাচল, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার প্রভৃতি এলাকায় হাজংরা ইতস্তত ছড়িয়ে আছে।
বৃহত্তর বড়ো জাতির অন্তর্ভুক্ত মঙ্গোলীয় মহামানবগোষ্ঠীর রক্তধারায় বাহিত হাজংদের সম্পর্কে নৃতত্ত্ববিদ কর্ণেল ই টি ডাল্টন-এর মতামত হলো, হাজংরা আসামের আদিম অধিবাসী এবং কাছাড়ী নামক বৃহত্তর জাতির শাখা। অনেক পণ্ডিতের ধারণা সংস্কৃতি ও ভাষাগত পার্থক্য সত্ত্বেও পাশাপাশি বসবাসরত হাজং ও গারো একই বৃহৎ জাতির দুটি গোষ্ঠী। অনেকে আবার হাজংদের কোচ জাতিরই সহোদর মনে করে। কিন্তু হাজংরা সবসময়ই নিজেদের আলাদা জাতিসত্তার মানব মনে করে আসছে।
হাজং ভাষায় কোনো লেখ্য রূপ নেই। ডক্টর গ্রীয়ারস হাজং ভাষাকে টিবেটু-বার্মান ভাষাভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে, হাজং ভাষায় বাংলা ও অহমীয়া ভাষার সংমিশ্রণ রয়েছে এবং বাংলা লোকজ শব্দের প্রচুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যদিও হাজংদের ভাষায় বর্ণমালা নেই, তথাপি মুখে মুখে শ্রুত তাদের লোকসাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ এবং হাজংদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বর্ণাঢ্য। হাজংরা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে এখনও আদিবাসীদের নানা আচার-অনুষ্ঠান এবং অনক্ষর সমাজের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
বলা হয়ে থাকে, হাজংরাও এক সময় পাহাড়ের অধিবাসী ছিল এবং জুম চাষ করতো। কিন্তু বর্তমান হাজংরা পাহাড়ের পাদদেশে নদী, খাল, ছড়ার তীর ঘেঁষে বাড়ি-ঘর করলেও মূলত তারা সমতল ভূমির অধিবাসী এবং তাদের উৎপাদনের উপজীবিকা হলো সমতল ভূমিতে হালচাষ।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রবহমান হাজংরা আবহমান কাল ধরে যূথবদ্ধভাবে বাস করে আসছে। এই যূথবদ্ধতার প্রতীক হলো পাড়ায় পাড়ায় তাদের বাস্তুদেবতা প্রতিষ্ঠা। প্রতি বছর সাড়ম্বরে হাজংরা বাস্তুদেবতার সর্বজনীন পূজা করে।
এই গ্রন্থে হাজংদের সমাজব্যবস্থা, উত্তরাধিকার ও বিবাহ, ধর্মাচার, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, উৎসব-পার্বণ ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়াও আলোচিত হয়েছে ঐতিহাসিক হাজং বিদ্রোহ। যা বৃহত্তর বাঙালি পাঠকসহ সকল আদিবাসী পাঠকদের হাজংদের সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করবে।
হাজং জাতিসত্তা
মুস্তাফা মজিদ
















